
প্রকাশিত: Thu, Apr 13, 2023 1:50 PM আপডেট: Tue, Jun 24, 2025 8:27 PM
নববর্ষের উৎসব বিশে^র জাতিতে জাতিতে প্রেরণার উৎস ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: পহেলা বৈশাখ বিশে^র যেখানেই বাঙালি আছে, তাদের কাছে এদিনটি নতুন বছরের বার্তা অবচেতনেই নিয়ে যাবে। পৃথিবীর অন্য জাতিগোষ্ঠীগুলোও নিজ নিজ ভূখণ্ডে এমনিভাবে নিজেদের নতুন বছর উদযাপন করে থাকে। এখন ২১ শতকে বসে আমরা এই উদযাপনে শুধু সাংস্কৃতিক কিছু অনুষ্ঠানই দেখি না, এর সঙ্গে নববর্ষের বিরাট অর্থনীতি জাতীয় জীবনে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশে নতুন বছরের উৎসব পালনে রঙবেরঙের পোশাক, গহনাগাটি, দ্রব্যসামগ্রী কেনাবেচা চলে বেশ আগে থেকেই। কিন্তু আমরা ১ বৈশাখ তারিখে নতুন পোশাক, জুতা, স্যান্ডেল, গহনা ইত্যাদি পড়ে বৈশাখী অনুষ্ঠান উপভোগ করতে যাই। শহুরে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, এমনকি সাধারণ মানুষও নতুন বছরের এই দিনটিতে কিছুটা হলেও উৎসবের মেজাজে থাকেন। ঘরে নতুন কিছু খানাপিনার আয়োজন হয়, যাদের অর্থবিত্ত বেশি তারা হোটেল রেস্তোরাতে গিয়ে কিংবা আনিয়ে নতুন বছরের খানাপিনা পারিবারিকভাবে বা নিকটজনদের সঙ্গে একত্রে উপভোগ করে থাকেন।
গ্রামাঞ্চলে বিষয়টি এতটা হয়তো বিকশিত হতে পারেনি। তবে মেলার আয়োজনে থাকে নানান পণ্যসামগ্রী, যা বেচাকেনায় মত্ত্ব হন এলাকাবাসীরা। মেলাকে জমজমাটে পরিণত করেন নানা পেশা আর সংস্কৃতিসেবী লোকজন যারা গানবাজনা বাজিয়ে মানুষকে শুধু আনন্দই দেয় না, কিছু উপার্জন করারও সুযোগ পায়। কোথাও মেলা চলে কয়েকদিনব্যাপী। আমাদের দেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ আরো অনেক ছোট ছোট জাতি রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় একই সময়ে তিন জাতিগোষ্ঠীর নববর্ষের উৎসব বৈশাবি উদযাপিত হয়। তাদেরও আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতি জীবনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নবর্বষের ঐতিহ্য শত শত বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু ও ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হতো। মধ্যযুগে সম্রাট আকবর ভারতবর্ষের নববর্ষের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য চান্দ্রমাসের দিনক্ষণকে এই উৎসব পালনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে দেখলেন। কারণ নববর্ষ উৎসব উদযাপনের সঙ্গে সরকারি বাৎসরিক খাজনা আদায়ের প্রথা জড়িত ছিলো। কিন্তু চান্দ্রমাস যেহেতু প্রতিবছরই ১০ দিন করে এগিয়ে আসে তাই বছরের ফসল কাটা, কৃষকের হাতে অর্থ আগমনের নির্ধারিত সময় রক্ষা করা সম্ভব ছিলো না। তাই আকবর দিনটিকে বছরের নির্ধারিত সময়ের ফসল তোলা এবং খাজনা দেওয়ার সময় বিবেচনা করে নির্ধারণ করার চিন্তা থেকেই রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণের আদেশ দেন।
১৫৮৪ সালের ১০ অথবা ১১ মার্চ এটি প্রবর্তিত হয়। তবে সম্রাটের ক্ষমতা আরোহণ যেহেতু ১৫৫৬ সালে ঘটেছিলো তাই এর শুরু ধরা হয় সেই বছরটি থেকেই। এরপর সুবেদার মুর্শিদকুলী খান বাংলায় আকবরের রাজস্ব নীতি অনুসরণ করেন। জমিদাররা চৈত্র মাসের শেষদিন হালখাতা খুলে বছরের খাজনা আদায় করতেন আর সবাইকে মিষ্টান্ন খাওয়াতেন। কৃষক ফসল বিক্রি করে এই সময়েই জমিদারদের খাজনা দিতে আসতেন। এটি কৃষি অর্থনীতির একটি বিশেষ দিন হিসেবে এই অঞ্চলে একভাবে পালিত হতে থাকে। স্বভাবতই মানুষের ঘরে তখন নতুন কাপড়চোপড় কেনাকাটা এবং আত্মীয়-স্বজনদের উপহার দেওয়ার একটি নিয়ম হিসেবে চালু হয়ে যায়। ফলে নানা পেশার লোকজন নববর্ষকে কেন্দ্র করে মেলায় পসরা সাজাতো। সবচাইতে বড় বাণিজ্য মেলা হিসেবে মধ্যযুগে আমাদের এখানে নতুন বছরের উৎসবকেই বেছে নেওয়া হতো। সুতরাং এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলো মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যার ওপর রাষ্ট্রব্যবস্থাও অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিলো। সুতরাং যারা বাংলা নববর্ষের উদ্ভবের এই ঐতিহাসিক সম্পর্কগুলো সম্পর্কে জানেন না তারাই কেবল এর উৎপত্তি নিয়ে মনগড়া কিছু কথা বলেন। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো বিশেষ সম্পর্ক বা বিরোধের কোনো কারণই খোঁজার ভিত্তি নেই।
সম্রাট আকবর কিংবা ফতেহউল্লাহ সিরাজি যেই ক্যালেন্ডারটি প্রবর্তন করেন সেটিকে সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়ে কোনো মুসলমান আসলে নিজের অজ্ঞতাকেই যেন প্রকাশ করে থাকেন। একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী যদি প্রশ্ন তুলে বলতো যে সম্রাট আকবর যেহেতু এই দিবস এবং উৎসব পালনের সুযোগ করে দিয়েছেন। এটি তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয় বলে তিনি দাবি করতে পারতেন। কিন্তু ভারতবর্ষে তখনো তেমন ওজর আপত্তি কেউ কখনো করেনি। কারণ এর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বা বিরোধ নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে অর্থনৈতিক স্বার্থে গঠিত হয়েছে।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব নববর্ষ রয়েছে। নববর্ষ গড়ে ওঠার পেছনে সর্বত্রই জড়িত রয়েছে জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার একটি বিশেষ সময়, যখন বৃহত্তর জনগোষ্ঠী দিনটি পালন করার মতো আর্থিক কোনো প্রণোদনা, সুযোগ-সুবিধা বা ব্যবস্থায় থাকে। মানব ইতিহাসে প্রাচীন যুগের বেশ আগেই যখন কৃষি অর্থনীতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুব সীমিত আকারে হলেও শুরু হয়। তখনই সেই জাতিগোষ্ঠী নতুন ফসল পাওয়ার আনন্দকে সমবেতভাবে উদযাপন করার একটি ধারা তৈরি করে। একসঙ্গে সকলে মিলিত হয়ে ভুরিভোজ করা, আনন্দ করা, নাচগান করারও ব্যবস্থা হতো। কারণ গোত্রীয় সমাজের বেশির ভাগ মানুষই কোনো খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করতে জানতো না। যখনই তারা ফসল ফলানোর কাজে অপরের দেখাদেখি আত্মনিয়োগ করতে শিখলো তখনই তারা নিজেদের খাদ্য উৎপাদনের একটি সুযোগ হাতের কাছে পেলো। সেটিকে ধরে রাখার জন্যই মানুষ নদী, খাল, সাগর তীরে বসবাস, চাষাবাদ, পানিসেচ ইত্যাদি করতে শিখলো। সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারভাটার সঙ্গে পরিচিত হলো। চাঁদ দেখে তারা জোয়ারভাটা বুঝতে শেখে, সময় গণনাও এভাবে করতে শিখে। ক্রমেই মানুষ গণনা শিখে দিনক্ষণ গুণতে শিখে। ফসল ফলানোর সময়টাকেও তারা চাঁদ বা সূর্যের উদয়াস্তের মাধ্যমে গণনা করতে শেখে। এক পর্যায়ে এসেই মানুষ দিনপঞ্জিকা তৈরি করে। ততদিনে কৃষি বিপ্লব সাধিত হতে থাকে।
আজ থেকে ১৪ হাজার বছর আগে কৃষিবিপ্লব মানবজীবনকে সভ্যতায় উন্নীত করার ক্ষেত্র রচনা করে। আর তখন থেকেই মানুষ কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে যায়। সেটি সেই সুদূর জাপান, চীন থেকে শুরু করে আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ সর্বত্রই ঘটতে থাকে। এসব অঞ্চলে বসবাসকারী সব মানুষই ফসল কাটা আর ঘরে তোলার সময়ে একসঙ্গে কাজ করতো, খাওয়াদাওয়া করতো, আনন্দ উৎসবও করতো। কারণ পেটপুরে খাওয়ার এমন সুযোগ মানুষের আগে কখনো ছিলো না। কৃষি অর্থনীতি তাকে শুধু খাদ্য উৎপাদনই দেয় নি, নতুন জীবনব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও অবারিত করে দেয়। সেই অবারিত স্বাধীনতা থেকেই দেশে দেশে নানান ধরণের মেলার আয়োজন ঘটে। যেগুলোতে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বেচাকেনার ব্যবস্থা তৈরি হতো। আরবের মানুষরা তো বছরের অনেকগুলো দিনই নির্ধারণ করে রাখতো কোথায়ে কোন মেলা কখন বসবে, সেই মেলায় কি কি পণ্য নেওয়া যাবে, কেনা যাবে। মেলাগুলোই তাদেরকে আর্থিক সংস্থান করার সুযোগ করে দিতো। প্রাচীন পারস্যের নওরোজ তথা নতুন বছরে এভাবেই মেলা সাজতো, অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থা উন্নত করার সুযোগ পেতো।
ইউরোপেও মধ্যযুগে বন্দরকেন্দ্রিক শহরগুলোতে মাসব্যাপী মেলা হতো, লাতিন আমেরিকায়ও মেলা বসতো, ইউরোপ থেকে দলে দলে জাহাজভর্তি পণ্য সেসব মেলায় নিয়ে যাওয়া হতো। চীনা প্রাচীন সভ্যতাও এই মেলায় নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও অর্জন করার সুযোগ পেতো। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে এখনো চীনারা সাড়ম্বরে নতুন বছর উদযাপন করে থাকে। পৃথিবীর হেন কোনো জনগোষ্ঠী নেই যাদের এমন ঐতিহ্য নেই। এই ঐতিহ্যের ভিত্তি হচ্ছে কৃষি অর্থনীতি, পরবর্তী সময়ে বণিকতন্ত্র। আজকের যুগে ডিজিটাল যন্ত্রপ্রযুক্তির উদ্ভাবিত অর্থনীতিও এইসব উৎসব আয়োজনে যুক্ত হয়েছে। সুতরাং পৃথিবীর দেশে দেশেই নতুন বছর ঐতিহ্যের যে সিঁড়ি রচনা করেছে তাতে সময়ের ভিন্নতা রয়েছে। কিন্তু ঐতিহ্যে যার যার বাস্তবতা তাতেই বিকশিত হচ্ছে। এই ধারণা যারা রাখেনা তারাই কেবল সাম্প্রদায়িকতার ওজর খুঁজছে। কিন্তু তারা জানে না ইতিহাস এই সবকিছু অনেক উর্ধ্বে। যেখানে মানুষ পৃথিবীব্যাপী অনেকটাই অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্যের অধিকারী। নববর্ষ সেরকমই এক ঐতিহ্য। লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
আরও সংবাদ
চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে
‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!
কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!
সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি
ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
মতিউর প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮৩ ব্যাচের বন্ধুদের গ্রুপে সৎ জীবন যাপনের উপদেশ দিতেন!

চ্যাম্পিয়ন ভারত : একটা ছোট মুহূর্ত কতো বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে

‘ওই ক্যাচ হয়নি, সুরিয়াকুমারকে আবার ক্যাচ ধরতে হবে’!

কতো দেশ, কতোবার কাপ জিতলো, আমাদের ঘরে আর কাপ এলো না!

সংগীতাচার্য বড়ে গোলাম আলি খান, পশ্চিমবঙ্গের গর্ব সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমি

ইন্ডিয়ান বুদ্ধিজীবী, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ও দেশের বুদ্ধিজীবী-অ্যাক্টিভিস্ট
